তাসলিমাদের
গল্প
হিমিকার জন্য প্রায়
প্রতিদিনই মেয়েটার কাছ থেকে এক তোড়া ফুল কিনে নিয়ে যাই। যতটা হিমিকাকে ভালোবাসার কারণে তার চেয়ে বেশি
ছোট্ট মেয়েটার প্রতি মায়া থেকে। অফিস থেকে ফিরতি পথে বিজয় স্বরণি মোড়ের সিগন্যালে
যখন গাড়ি থামে কিংবা নিজে থেকে থামিয়ে মেয়েটিকে ডেকে এক তোড়া ফুল কিনতাম। সিগন্যাল
পড়লেই মেয়েটার কি প্রানান্ত ছোটাছুটি এক তোড়া ফুল বিক্রির জন্য! অবাক হয়ে দেখতাম। গাড়িতে
গাড়িতে গিয়ে খোলা জানালায় উঁকি দিয়ে কিংবা বন্ধ সার্সীতে নাক লাগিয়ে টোকা দিয়ে
দিয়ে অনবরত বলতে থাকে “ স্যার নেন না স্যার, নেন না একটা তোড়া আফামণির জইন্যে। নেন
না স্যার।” কেউ নেয় কেউ নেয় না। তোড়াগুলি দেখতে আহামরি না। চকচকে রূপালি কাগজ,
পাতা বাহারির পাতায় ঘেরা কয়েকটি গোলাপ। মেয়েটার কাছ থেকে যখন ফুল নিতে পারি না
সেদিন মনটা কেমন খচখচ করে। মনে হয় কি নেই, কি হল না, কি যেন পেলাম না।
ছোট্ট
মেয়েটির নাম তাসলিমা আক্তার। থাকে শেকেরট্যাক বস্তিতে। শ্যাম বর্ণ গায়ের। বয়সে
১০-১২ বছরের বেশি না। প্রথম যেদিন দেখি সেদিন ছেঁড়া ময়লা ফ্রক আর প্রয়োজনের তুলনায়
অনেক বড় ঢোলা এক পাজামা পরা ছিল। মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো চুল। ফুল
বিক্রির জন্য ছোটাছুটি করছ। দেখে চোখ আটকে গেল। নিষ্পাপ চেহারা। চোখ আটকে যাবার মত
ওর চেহারায় কি যেন একটা আছে। ওকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিন ওর বয়সী আমার ভাগ্নীর কথা
মনে পড়েছিল। আচ্ছা আমার ভাগ্নী যদি এখানে এমন অবস্থায় দৌড়তো আর ফুল বিক্রি করত
তাহলে তা দেখে আমার মনের অবস্থা কেমন হতো? ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওকে ডেকে
সবফুল গুলো কিনে নিলাম। মেয়েটা তো অবাক চোখে হাসি ভরা মুখ নিয়ে সিগন্যাল না শেষ
হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে রইল। আমার মনে হল ওকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে
দেই।
হঠাৎ বেশ কয়েকদিন
তাসলিমাকে দেখলাম না। ওর সাথে
ফুল বিক্রি করে এক
মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম তাসলিমার কি হয়েছে? এমন ভাবে উত্তর করল যেন ঘটনাটি
ঘেটেছে এটাই খুব স্বভাবিক। মেয়েটির উত্তর নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। “স্যার
তাসলিমা মইরা গেছে। এই হানেই সিংগাল ছারার পর পিছন থিক্কা একটা বাস ওরে চাপা দিয়া গেছিলো।
মাতার মজক বাইর হইয়া রাস্তায় পইরা আছিলো।”
আমি
কল্পনা করার চেষ্টা করলাম ঘটনাটা। ছোট্ট একটা মেয়ে ফুলবিক্রির জন্য অস্থির হয়ে
রাস্তায় ছোটাছুটি করছে। পেছন থেকে একটা দ্রুত গতির বাস পিশে চলে গেলো। রাস্তায় পরে
রইল ছোট্ট একটা মেয়ের থেতলানো লাশ। লাশের
চারপাশের রাজপথ রক্তে ভিজে
গেছে। কিছু ফুল হয়ত তখনো হাতে শক্ত মুঠি
করে করে
ধরে রাখা, আর কিছু ফুল থেঁতলে ছিঁড়ে চারদিক ছড়িয়ে পরেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন