শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১২

ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতন হবার এখনই সময়- প্রবন্ধ ( ০৫.০৯.২০১২)

ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতন হবার এখনই সময়
সবাইকে শুভেচ্ছা,
খুব কম সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকবার মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে দেশ। যা অবশ্যই আমাদের জন্য অশনি সংকেত। বিশেষজ্ঞরা দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আশঙ্কা ঢাকায় রাতের বেলায় ৭-৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে প্রায় ৯০ হাজার এবং দিনের বেলায় হলে ৭০ হাজার মানুষ হতাহত হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৩ লক্ষ ২৬ হাজার ভবনের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ৭-৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। যার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা (৬ বিলিয়ন ডলার)
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে ঢাকা ও তেহরানকে সর্বোচ্চ ভূমিকম্প প্রবণ শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ১০০ বছেরর বেশি সময় দেশে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি, তাই ১৯৯৮ সালের পর যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ভূমিকম্প সম্পর্কে যথেষ্ঠ সচেনত এবং প্রস্তুতির এখনই সময়।
ভূমিকম্প বলতে পৃথিবীর উপরি ভাগের কোন অংশের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনকে বোঝায়। ভূমিকম্প মূলত তিনটি কারণে হতে পারে।
১) ভূপৃষ্ঠ জনিত
২) আগ্নেয়গিরি জনিত
৩) শিলাচ্যুতি জনিত

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সতর্কতা অবলম্বন করে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সবদিক থেকে কমানো যায়। ভূমিকম্পের প্রস্তুতির মূলত তিনটি অংশ-
১। ভূমিকম্প পূর্ব প্রস্তুতি
২। ভূমিকম্প কালীন করণীয়
৩। ভূমিকম্প পরবর্তী করণীয়
বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার গত ১৪৩ বছরের ভূমিকম্পের রেকর্ড--
সাল
স্থান
মাত্রা
১৮৬৯
সিলেট
৭.৫
১৫ জুন ১৮৮৫
মানিকগঞ্জ
৭.০
৮ জুলাই ১৯১৮
শ্রীমঙ্গল
৭.৬
২ জুলাই ১৯৩০
ধুবড়ি,আসাম
৭.১
১৫ জানুয়ারী ১৯৩৪
বিহার
৮.৩
৩ জুলাই ১৯৩৪
আসাম, ভারত
৭.১
১৫ আগস্ট ১৯৫০
আসাম, ভারত
৮.৭
২২ নভেম্বর ১৯৯৭
চট্টগ্রাম
৬.০
১৯৯৯
মহেশখালী দ্বীপ
৫.২
২৭ জুলাই ২০০৩
বরকল উপজেলা, রাঙামাটি
৫.১




হতাহতের দিক থেকে পৃথিবীর বড় ভূমিকম্পের রেকর্ড-
তারিখ
স্থান
হতাহত
মাত্রা
২৩,জানুয়ারী১৫৫৬
শানজি, চায়না
৮২০,০০০-৮৩০,০০০
৮.০(অনুমিত)
২৮,জুলাই১৯৭৬
ট্যেংশান, চায়না
(Tangshan)
২৪২,৪১৯-৭৭৯,০০০
৭.৫-৭.৮
২১, মে ৫২৫
এন্টিওচ,তুরস্ক
(Antioch,Turkey)
২৫০,০০০
৮.০
১৬,ডিসেম্বর১৯২০
নিনংজিয়া,গ্যানসু, চীন
২৩৫,৫০২
৭.৮
২৬,ডিসেম্বর২০০৪
ভারত মহাসাগর, সুমাত্রা,ইন্দোনেশিয়া
২৩০,২১০(ভূমিকম্প জনিত ৎসুনামি)
৯.১-৯.৩
১১,অক্টোবর১১৩৮
এলেপ্পো (Aleppo), সিরিয়া

২৩০,০০০
অজানা
১২,জানুয়ারী২০১০
হাইতি
২২২,৫৭০
৭.০
২২,ডিসেম্বর ৮৫৬
ড্যেমঘান(Damghan), ইরান

২০০,০০০
৭.৯(অনুমিত)
২২, মার্চ ৮৯৩
আর্দাবিল (Ardabil), ইরান
১৫০,০০০(অনুমিত)
অজানা
১, সেপ্টেম্বর১৯২৩
ক্যানটোঅঞ্চল(Kantõ Region), জাপান
১৪২,০০০
৭.৯

ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহত হয় অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। তাই তৈরির সময়ই সব ধরনের অবকাঠামোই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা করে তৈরি করতে হবে। তবে পুরাতন বাড়ি যা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয় তা আরো মজবুত করা যায়।

পুরাতন বাড়ির ক্ষেত্রে করণীয়-
১। বাড়ি ছাদ এবং দেয়ালে ফাটল থাকলে তা চিহ্নিত করে মেরামত করুন।
২। বাড়ির কম শক্তিশালী কলাম অতিরিক্ত টানা রড বা তারের জালির মাধ্যমে (ফেরোসিমেন্ট পদ্ধতি) চিপিং করে ফেরোসিমেন্ট ব্যবহার করুন।
৩। প্রতিটি ঘরের কোণায় খাড়াভাবে অতিরিক্ত কংক্রিটের কলাম ইস্পাতের রড সহ নির্মান করুন।
৪। দেয়াল মজবুত করার জন্য দরজা-জানালার দুই দিকে খাড়া রড গাঁথুন।
৫। বাড়ির বীমা করা না থাকলে বীমা করিয়ে রাখুন।

বাড়ি নির্মানে করণীয়-
১। বাড়ি নির্মাণ সরকারি ও কারিগরি নিয়মকানুন মেনে চলুন।
২। দক্ষ প্রকৌশলি দিয়ে নকশা তৈরি ও তদারকি করান।
৩। অবশ্যই বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি তৈরি করুন।
৪। ভবনের উচ্চতা ও ওজনের হিসেব অনুযায়ী শক্ত ভিত দিন।
৫। ভাল মানের সিমেন্ট, রড, বালু ইত্যাদি ব্যবহার করুন।
৬। কলামের রডে বাঁধনগুলির শেষ মাথা ১৩৫ কোণ হবে এবং বাঁধনগুলির দূরত্ব অন্য জায়গার চেয়ে অর্ধেক হবে অর্থাৎ কম ফাঁকা হবে।
৭। বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন গ্যাস লাইন নিরাপদ ও সতর্কভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে তাৎক্ষণিক ভাবে বন্ধ করা যায়।
৮। নরম মাটির উপরে ভবন নির্মানে সতর্কতা অবলম্বন করুন

ভূমিকম্প পূর্ব প্রস্তুতি-
১। ভবনের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে নিরাপদ স্থানটি জেনে রাখুন।
২। ঘরের ভারি জিনিসপত্র সর্বদা কম উচ্চতায় রাখুন।
৩। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পরিবারের সদস্য ও কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের সচেতন করুন।
৪। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, পোষাক প্রস্তুতকারী কারখানা ও অন্যান্য অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্পকালীন করণীয় বিষয়ে মহড়ার আয়োজন করুন।
৫। ঘরের ভারি আসবাব (যেমন-আলমারি, ছবির ফ্রেম, বড় ফুলদানি,টব ইত্যাদি)যাতে ভূমিকম্পের সময় পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে সেজন্য পেছন থেকে আংটা লাগিয়ে দেয়ালের সাথে আটকিয়ে রাখুন
৬। ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কেন্দ্র সমূহের টেলিফোন নম্বর বাড়ির প্রকাশ্য স্থানে রাখুন যাতে সকলে দেখতে পারে।
৭। বহুতল ভবন, মার্কেট,হোটেল, বিদ্যালয়,সিনেমা হল ইত্যাদির সিঁড়ি প্রশস্ত করুন ও জরুরি বহির্গমনের দরজা ও সিঁড়ির ব্যবস্থা করুন।
৮। ভূমিকম্পকালীন আত্মরক্ষার স্বার্থে ঘরে সবসময়ের জন্য রেডিও, টর্চ লাইট, হাতুড়ি, হেলমেট, কুড়াল, ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সমূহ একটি ব্যাগে মজুদ রাখুন।
৯। অগ্নি নির্বাপন, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ধারণা গ্রহণ করুন।
১০। শিশু-কিশোরদের ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে ধারণা দিন এবং বছরে একাধিক মহড়া দিন।
১১। ভবনের প্রতিতলায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ( ফায়ার এক্সটিংগুইসার ) উন্মুক্ত ও নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করুন এবং সবাইকে এর ব্যবহার শিখিয়ে রাখুন।
১২। পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে তাদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা এবং সন্ধান ও উদ্ধার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন।
১৩। দাহ্য জ্বালানী ঘরের বাইরে সংরক্ষণ করুন

ভূমিকম্প কালীন করণীয়-
১। ভূমিকম্প অনুভূত হলে শান্ত থাকুন। আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করবেন না কিংবা তাৎক্ষণিক ভাবে বাড়ি থেকে বের হবার চেষ্টা করবেন না।
২। ভূমিকম্প অনুভূত হলে ঝুঁকে পরে মাথা বালিশ কুশন বা হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে দরজার চৌকাঠ, শক্তটেবিল, ডেস্ক, খাট বা বেঞ্চের নিচে আশ্রয় নিন
৩। লিফট বা এলিভেটর ব্যবহার করবেন না।
৪। উঁচু বাড়ির ছাদ , জানালা বা সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে নামবেন না।
৫। জলন্ত গ্যাসের চুলা নিভিয়ে ফেলুন এবং সম্ভব হলে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল সংযোগ দ্রুত বিছিন্ন করুন।
৬। বারান্দা, ব্যালকনি, জানালা, আলমারি কাঠের আসবাব পত্র বাঁধানো ছবি বা অন্য কোন ঝুলন্ত ভারি বস্তু থেকে দূরে থাকুন।
৭। রান্নাঘরে থাকলে যতদ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসুন।
৮। ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু ভবন,বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলাস্থানে আশ্রয় নিন।
৯। জনাকীর্ণ ঘরে (যেমন-পোষাক প্রস্তুতকারী কারখানা, হাসপাতাল, সিনেমা হল,স্কুল, মার্কেট) থাকলে বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি করবেন না। পন্য সামগ্রীর শেল্ফ থেকে দূরে আশ্রয় নিন এবং দু হাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন।
১০। গাড়িতে থাকলে ওভারব্রীজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত ভেতরেই অবস্থান করুন।
[ বিঃদ্রঃ- ভূমিকম্প সাধারণত ৩০-৪০ সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং তা আমাদের বুঝতেই ৫-১০ সেকেন্ড চলে যায়। তাই ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে দৌড়ে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ]


ভূমিকম্প পরবর্তী করণীয়-
১। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারো কম্পন হতে পারে। তাই প্রথমবার অনুভূত কম্পন থেমে যাওযার পর ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।
২। বৈদ্যুতিক / টেলিফোনের খুঁটি, উঁচু দেয়াল ও ভবন থেকে দূরে থাকুন।
৩। গ্যাস বা অন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্যের গন্ধ পেলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
৪। জরুরি তথ্য ও নির্দেশাবলী পাওয়ার জন্য রেডিও টেলিভিশন ব্যবহার করুন।
৫। উদ্ধার কাজে তৎপর সংস্থাসমূহকে সহযোগিতা করুন।
৬। উদ্ধারের ক্ষেত্রে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধিদের অগ্রাধিকার  দিন।
৭। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ও শিশুদের সান্ত্বনা দেবার জন্য কাউকে সার্বক্ষণিক ভাবে ওদের পাশে রাখুন।
৮। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করুন।
৯। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিন এবং প্রয়োজনে দ্রুত ও নিরাপদে হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিন।
১০। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় গলি ও প্রধান সড়ক পথ থেকে ধ্বংসস্তুপ অপসারণে অংশগ্রহণ করুন যাতে উদ্ধার কর্মী বাহিনী দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারেন।
১১। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া টেলিফোন ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না কারণ এতে জরুরী সেবা বিভাগের যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
১২। ভাঙা দেয়ালের নীচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করা উচিত না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে যাতে ধুলাবালি শ্বাসনালীতে না ঢোকে। সম্ভব হলে দেয়ালের পাশে সরে এসে উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এ সময় যেন শ্বাসযন্ত্রে ধুলোবালি না প্রবেশ করে।
[বিঃদ্রঃ- বড় মাত্রার ভূমিকম্প এবং দীর্ঘ সময় ধরে কম্পন “পরবর্তী ভূ-কম্পনের’’ (আফটার শকের) সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। অতএব, এ বিষয়ে সতর্ক থাকুন]

তথ্য সূত্র-
১। দৈনিক প্রথম আলো ( ২১,সেপ্টেম্বর ২০১০)
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ
৪। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত প্রচারপত্র
৫। কম্প্রিহেনসিভ ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয় এবং ডিসিসি কর্তৃক প্রকাশিত প্রচারপত্র
৬। বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক অফিস ফর আরবান সেফটি (BNUS) ,বুয়েট কর্তৃক প্রকাশিত পোস্টার



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন