সাদা তুলোর মতো মেঘ গুলো নীল আকাশের গাঁ বেয়ে কোথায় চলছে ছেলেটি জানে না। ওর
খুব ইচ্ছে করে মেঘ গুলির পিছু পিছু ছুটে গিয়ে দেখে আসে ওরা কোথায় যায় দল বেঁধে। কিন্তু তার কোন উপায় নেই। সকাল হতেই ওই গনগনে সূর্যটাই বা হঠাৎ ঐ নোংরা দালান গুলির পেছন থেকে কিভাবে উঠে আসে? অনেক চিন্তা করেও ওর ছোট মাথা থেকে এর কোন উত্তর বের করতে পারে নি। বড়দের কাছে গেলে কি সব কাঠখোট্টা ব্যাখ্যা দেয় তার মাথা মুন্ডু কিছুই বোঝে না। তাই হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় ধ্যাত নিজে গিয়ে দেখে আসা যেতো যদি। এ রকম শত শত প্রশ্ন ওর মনের জানালায় অহরহ উঁকি দেয়। আর
এরকম শত প্রশ্ন নিয়েই ছেলেটি বড় হচ্ছে। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর সব সময় ও পায় না। বড়দের প্রশ্ন করলেই হয় দায়সারা কোন উত্তর দেয় নয়ত বিরক্ত হয়, রাগ করে বলে এত প্রশ্ন কেন বাপু? একটু ভদ্র হবার চেষ্ট কর দেখি।
সঙ্গীদের
নিয়ে দল বেঁধে সবুজ ঘাসের ওপর পা চালিয়ে, ঘাস মাড়িয়ে দৌড়োনোর ওর কোন সুযোগ নেই। ও জানে না- ঘাস ফড়িং দেখতে কেমন, মাঠের পর পর মাঠ সবুজ কচি ধান ক্ষেতে উথলা দখিনা বাতাস লাগলে কিভাবে সেগুলো দোল খায়, রঙিন প্রজাপতি বুনো ফুলের ওপর বসলে দেখতে কেমন লাগে কিংবা নদীর এ পাড়ে দাঁড়িয়ে ও পাড়ে সবুজ দিগন্ত রেখায় হারিয়ে যাওয়া সূর্য দেখতে কেমন লাগে; আরো কত কি!
ছেলেটি
ঢাকা শহর নামে জেল খানার কোন এক বন্দী কুঠুরিতে থাকে। সকাল
হতেই স্কুলের গাড়ি আসে নেবার জন্য। হুড়োহুড়ি করে কোন মতে গাড়িতে বন্দী হয়ে ধুলো-ধোঁয়া, ডাস্টবিন, দোকান পাট আর জীর্ণ এই শহর দেখতে দেখতে স্কুলে পৌঁছে যায়। ও এবার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, সবে সাত শেষ হল। পড়াশুনায় খুব মনযোগি বলে ওর বাবা-মা খুব খুশী। স্কুল ছাড়া বাকি সময় ওকে ঘরেই বন্দী থাকতে হয়। বাবা-মা মাঝে মাঝে এদিক ওদিক বেড়াতে নিয়ে যায়, দামী খাবার খাওয়ায়, উপহার কিনে দেয়। তবুও কি যেন নেই, কি যেন নেই মনে হয় ছেলেটির। ছেলেটিও জানে না, বাবা-মাও বোঝে না। বাবা-মা মনে করে ওর কিসের অভাব, খাবে দাবে আর পড়াশোনা করবে ব্যাস। দিনের
বেশির ভাগ সময়ই ওকে বাসার কাজের মহিলাটির সাথে কাটাতে হয়। বাবা-মা দু’জনই চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছেলেটিকে দেবার মত তাদের সময় কম।
শাওন মাসের এক বৃষ্টি ভেজা দিন। বাবা-মাকে অনেক বলে-কয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখল।বারান্দায়
দাঁড়িয়ে
হঠাৎ ওর
আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ গুলোকে ধরতে ইচ্ছে করল, হাত বাড়িয়ে ধরতে পারল না। তাই খুঁজে পেতে কোথা থেকে এ্যালুমিনিমের
একটা রড নিয়ে এসে বারান্দার শিক গলিয়ে আকাশ পানে তুলে ধরল কালো মেঘ গুলো ধরার জন্য। রডটি তুলে ধরতেই মেঘগুলো যেন সভয়ে আরো ওপরে উঠে গেল। আর ছেলেটির বের করে দেয়া রডটি মেঘের কাছে না পৌঁছে গিয়ে পড়ল খোলা বিদ্যুতের লাইনের ওপর। বিদ্যুৎ
পৃষ্ঠ হয়ে ছেলেটি ওভাবেই আকাশের দিকে চেয়ে রইল। কাজের মহিলা ডাকতে এসে কোন সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিতেই বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হয়ে দুজনেই মারা পড়ল।................
অনেক বছর কেটে গেল, ওই সন্তান হারা দম্পতির অনেক বয়সও হল কিন্তু তাদের ছোট্ট অবুঝ ছেলেটির কথা এখনও ভুলতে পারে নি। ভুলতে পারে নি ওর কোমল চাহনি,নরম তুলতুলে গাল, এলোমেলো চুল, ছোট ছোট হাত পা, দুষ্টুমি মাখা হাসি আর বোকার মত প্রশ্ন গুলো। বাবা এখনও নিজের আজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মা ঘুমের ঘোরে সন্তানের নাম ধরে আর্তনাদ করে ওঠে। আর জেগে থাকলে ভাবে আমরা কি সবাই চাইলে পারতাম না শিশুদের জন্য আরো সুন্দর একটি সমাজ উপহার দিতে যেখানে শিশুরা থাকবে আরো নিরাপদ, আরো উচ্ছ্বল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন