অমরত্বের অভিশাপ
মন খারাপ থাকলে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, চারদিক দেখি। ফুটপাতে
হাঁটছি হঠাৎ মৃদু উচ্চারণের কিছু শব্দ কানে পৌঁছুল- "এই ঔষধ খেলে চিরঞ্জীবী হয়ে
যাবেন।" আমি ভিড় ঠেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো এক সৌম্য
দর্শন বৃদ্ধ। পরনে সাদা আলখাল্লা। উজ্জল বর্ণ, দীর্ঘ দেহ। চুল, দাঁড়ি, গোঁফ, ভ্রু সবই সাদা হয়ে গেছে। লম্বা নাক, উঁচু কপাল,কপালে ঘন বলীরেখা যেন সব সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন। সোজা টানটান বুক। তবে
শরীরের সব চামড়া কুঁচকে গেছে। মনে হয় যেন
সুপ্রাচীন বটগাছ, নাকি শত শত বছরের পুরোনো কাছিম! বৃদ্ধটি তার ধারালো দৃষ্টি দিয়ে
সবাইকে একবার পরখ করে নিল। দেখুন বিশ্বাস করুন বা না করূন সেটা আপনাদের ব্যাপার। অনেক
আস্তে আস্তে টেনে টেনে অপরিচিত কন্ঠে পৌঢ় বলল। এই ঔষধ তৈরিতে ৩৩টি গাছের নির্যাস লেগেছে,
যার ৩২ টিই এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। এই ঔষধের উপজাত সংগ্রহ করা হয়েছে মঙ্গোলিয়ার
স্তেপ, তিব্বত এবং নেপালের দুর্গম পাহাড়, আফ্রিকা, অমাজান,সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল,
মরুভূমি থেকে। যিনি এই চিরঞ্জীবী বনৌষধ তৈরি করেছেন তিনি আমার গুরু এবং তিনি একজন
চীনা। বুড়ো একই স্বরে বলেই চলল। যারা এটি নিতে চান তারা পাঁচশ টাকা করে দিলে আমি
দু ফোঁটা করে খাইয়ে দেব। প্রথমে একটু মাথা ঝিমঝিম করবে, ধীরে ধীরে হাত পা অবশ হয়ে
আসবে, মাথা ভারী হয়ে আসবে।মাথা আর কাজ করবে না। তিন দিন একটানা ঘুমাবেন। তবে একটা
ব্যাপার এই তিন দিন আপনি আপনার জন্ম থেকে এই ঘুমের আগ পর্যন্ত আপনার জীবনে যা ঘটেছে
তা বেশ কয়েকবার স্বপ্নে দেখবেন। তবে সেটা স্বপ্ন নয় একেবরে বাস্তব মনে হবে। ঘুম
থেকে উঠলেই আপনি অমর হয়ে যাবেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ছাড়া আপনার মৃত্যু হবে না।
একে তো পাঁচশ টাকার ঠেলা তার ওপর এসব উদ্ভট আর ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা শুনে যাও
মানুষ ছিল তারাও পলাল। থাকলাম শুধু আমি। কারণ জীবনের প্রতি আমার আর কোনো মায়া নেই। অঢেল সম্পত্তিও নেই। বাবা-মা কিছু রেখে গেছেন তাই দিয়েই চলছি। মা-বাবাকে হারিয়েছি অনেক দিন, গ্রাম থেকে শহরে এসেছি, ক্ষ্যাপার মত
ঘুরে ফিরে বেড়াই আর জীবনের অর্থ খুঁজি। পড়াশুনা করি। মাঝে মাঝে হতাশায় ডুবে আত্মহত্যার
পরিকল্পনা করি।
বৃদ্ধটিকে টাকা দিতেই সে বলল তুমি ঠকবে না বাবা । বাঁশের চোঙার শোলা আঁটা ছিপি
খুলে বাঁশের কঞ্চির চোখা করা মাথা ডুবিয়ে দু ফোঁটা হলুদ রঙের তরল খাইয়ে দিল আমায়।
অদ্ভুদ স্বাদ। না টক,ঝাল,মিষ্টি না তেতো বা নোনতা। পৃথিবীতে এমন স্বাদ ও হতে পারে না
খেলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। খাওয়ার সাথে সাথে মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল,
ক্ষণিকের জন্য চোখ ঝাপসা হয়ে এল। বৃদ্ধ আমায় বলল হাতে তোমার আর দেড় ঘন্টা সময় আছে।
তাই তাড়তাড়ি বাসায় এসে গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। সবাইকে সাবধান করে দিয়ে দরজার
সামনে একটা নোটিশ টানালাম- "একটানা তিনদিন ঘুমোবো কেউ বিরক্ত করবেন না ।"
এসব দেখে কেউ কিছু বলল না শুধু মুখ টিপে হাসল। জানে মাঝে মাঝে মাথায় বাতিক আসে। প্রবীণের
কথানুযায়ী সত্যি ঘুম চলে এল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখছি, স্বপ্ন নয় যেন
বাস্তব। পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলাম, খেলার মাঠ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় তারপর বুড়োর
ওই ঔষধ খাওয়া ঘুম।স্বপ্ন শেষ। না না আবার প্রথম থেকে শুরু। জন্ম, খেলার মাঠ,
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়,বুড়ো, ঔষধ,ঘুম,...... আবার আবার আবার। কতবার? হিসেব
নেই। আমি ঘুমন্ত অবস্তাতেই আতঙ্কিত হলাম। আমার জীবনের প্রতিটি অঙ্ক, দৃশ্য, সংলাপ
মুখস্ত হয়ে গেল। চলছে, চলছে,চলছেই......। ওহ্ কি আতঙ্ক। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলাম
চিৎকার করে -" এ স্বপ্ন আর দেখতে চাই না।" হুস হতেই চোখ মেলে বুঝলাম আমি
এক আত্যাধুনিক গবেষণাগারে আছি। আমার চিৎকার শুনে হাতা পা মাথা বিহীন কিছু চলনক্ষম
প্রাণী এসে আমাকে বলল "আমরা তোমাদেরই অত্যাধুনিক সংস্করণ। এখন ৯৯৯৯ সাল। এত
আগে চিরঞ্জীবী হবার কৌশল কিভাবে জানলে তা ভেবে আমরা বিস্মিত। এতদিন তুমি আমাদের হেফাজতেই ছিলে। তোমাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছি আমরা।" একটা ট্যাগ
লাগিয়ে পৃথিবীতে ছেড়ে দিল যাতে কেউ বিরক্ত না করে। সবই কেমন অদ্ভুদ পরাবাস্তব। নিজেকে
নিঃসঙ্গ, অসহায়, নিরুপায় মনে হল। হঠৎ কেউ কিছু বোঝার আগেই গাছের চোখা শক্ত একটা ডাল
বুকের বাম পাশে বসিয়ে দিলাম। রক্ত ক্ষরণে ধীরে ধীরে জ্ঞান লোপ পেল। জানি না কতক্ষণ
হবে জেগে দেখি আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। কোন ক্ষতের চিহ্ন নেই যন্ত্রনা নেই। শুধু
মনের পুরোনো সেই দুঃখ, বেদনা, নিঃসঙ্গতা, হতাশা। ওরা বলল তুমি চাইলেও আর মরতে
পারবে না। আমি চিন্তা করে আতঙ্কিত হলাম -"এই শূন্য, বেদনাময়, নিঃসঙ্গ জীবন
অনন্ত কাল ধরে কিভাবে আমি বয়ে বেড়াব?"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন