জারজ
আমি জারজ।
লোকে আমায় জারজ বলে। যখন ছোট ছিলাম তখন লোকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে আমার
দিকে আঙুল তুলতো আর বলেতো “তুই জারজ”। যখন বড় হলাম তখনও সবাই আমায় বলতো “ তুই জারজ”। তখন ওদের মুখে হাসি থাকত
না; থাকত বিতৃষ্ণা মাখানো ভ্রুকুটি। এমন তাচ্ছিল্য যেন ভাগারে মরা পঁচা গরুর
দেহাবশেষ। এই সমাজ আমার কপালে জারজের সিলমোহর দিয়ে
চিহ্ন এঁকে দিয়েছে যেমন আগেকার রাজারা তার দাসদের শরীরে উত্তপ্ত লোহার সিলমোহর
দিয়ে চিরস্থায়ী চিহ্ন এঁকে দিত। এ থেকে মুক্তি নেই। পালিয়ে গেলেও লোকেরা ঠিকই
চিনবে বিশেষ চিহ্নের কারণে।
ছোট বেলায় কেউ
আমাকে কোলে নিত না। সাকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখতে চাইত না। বলত তাতে নাকি
ওদের অমঙ্গল হবে। এখনও ওরা তাই বিশ্বাস করে। এ জারজ নামটি কখনও আমার পিছু ছাড়েনি।
ছায়ার মত নিত্য সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে আমার সঙ্গে। যখন বুঝতে শিখি প্রথম প্রথম
খুব খারাপ লাগত, কান্না পেত। কিন্তু আস্তে আস্তে এসব আমার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
পথের কুকুর যেমন পথেই ঘুমিয়ে, আস্তাবলে খেয়ে আর পথিকেরে লাথি খেয়ে অভ্যস্ত।
আমি যতখানি
কষ্ট পেয়েছি আমার হতভাগিনী মা তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট, লাঞ্চনা-গঞ্জনা, ধিক্কার
সহ্য করেছে। আমি যখন গর্ভে তখন আমার মায়ের বয়স সবে চৌদ্দ। সন্তান
জন্মের গরবে গরবিনী হতে পারে নি মা। যখন সন্তান সম্ভাবা এই মায়ের সন্তান জন্মের
চিহ্নগুলি ফুটে উঠতে থাকে তখন এই সমাজ এই ঘটনাটা আর বরদাস্ত করতে পারে নি। ওরা
আমার মায়ের দিকে আঙুল তুলে জোড় গলায় বলেছিল “তুই কলঙ্কিনী, তুই পাপাচারি, তুই দুশ্চরিত্রা, তুই
বেশ্যা, তুই চরিত্রহীনা। এই সমাজে তোর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তুই এই গ্রাম
থেকে বেরিয়ে যা। তোর এই গ্রামে কোন ঠাঁই নেই। তোরে দেখলেও পাপ হয়। তোর চেহারা আমরা
দেখতে চাই না। তোকে শরীয়ত মোতাবেক ১০১ টা দোররা মারা হবে।”
পাপাচারের
জন্য কোন্ মহাপুরুষটি দায়ী এ কৌতুহল ওদের মনে একবারের তরেও উদয় হল না। উদয় হল না
যে মহাপুরুষটির দোষ থাকলেও থাকতে পারে। ওরা পুরুষের দোষে হয়ত বিশ্বাস করে না। তাই
এই কলঙ্কের বোঝা শুধু আমার মায়ের ঘাড়েই চাপল। পাপিষ্ঠা মেয়ে মানুষের শাস্তির বিধান
আছে কিন্তু পাপিষ্ঠ পুরুষের শাস্তির বিধান কি আছে সমাজে? মেয়েদের নাম হয় কলঙ্কিনী;
কিন্তু এর পুরুষ বাচক কোনো শব্দই তৈরি হয় নি! এ অপরাধে অপরাধী হওয়া তো দূরের কথা।
মাকে একবার
জিজ্ঞেস করেছিলাম “মা আমার বাবা
কে? মা কি যেন বলতে চেয়েছিল! বলার জন্য উদ্যত হয়ে কোন অনির্দেশ্য দিকে আঙুল তুলে
নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছিল। যেন ঝড়ের
আগের মূহুর্ত। হয়ত এখনই কিছু বোঝার আগেই চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। তাই আমি এ
নিয়ে আর কখনো কোনো প্রশ্ন করিনি। প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম অনেক বার। কিন্তু সেদিনের
কথা মনে হতেই আর বলতে পানি নি। শুধু মনেমনে চিন্তা করেছি মা তোর তো কোন দোষ নেই।
তুই নির্দোষ। পাপ যদি হয়ে থাকে তবে তোদের দুজনের পাপই সমান সমান।
গ্রাম থেকে
বের করে দেবার পর মা ওই গর্ভাবস্থায়ই পাশের
গ্রামের এক ধনী দয়ালু লোকের বাসায় কাজের লোক হিসেবে আশ্রিত হয়। ওই গ্রামেও অনেকে
হুল্লোর শুরু করেছিল। কিন্তু দয়ালু লোকটি এটিকে আর বাড়তে দেন নি।
আমি যখন এই
পৃথিবীতে আসি সেদিন নাকি আমাবস্যার রাত ছিল। মা আর আমার বয়স্ক দাই মা থাকত গোয়াল
ঘরের পাশের ছোট্ট একটা ঘরে। আমাবস্যার রাত। কুপিতে তেলও নেই। মালিকেরাও ঘুমে। এরই
মধ্যে আমার পৃথিবীতে আসা। মাঝে মাঝে ভাবি ক্ষমাহীন পাপের ফল যে আমি, পৃথিবীতে এসে
সদর্পে চিৎকার দিয়ে আগমী বার্তা জানালাম এই ধরিত্রী মাতা তাকে কিভাবে সহ্য করল!
ঠেলে দূরে তো সরিয়ে দিল না, কোন শাস্তি তো দিল না কিংবা দোররা মারল না। তবে কি ধরে
নেব প্রকৃতির সৃষ্টিতে, প্রকৃতিতে কোন পাপ নেই? পাপের সৃষ্টি মানুষের মনে!
দাই মা আমায় বলত “ওরে আমার আন্ধার মানিক তুই আইসা আমার জীবনডা খুশীতে ভরাইয়া দিছস।”
দাই মার দুনিয়ায় কেউ ছিল না। একা। তাই মা ছেলেকে বুকে আগলে রাখত। মা গ্রামের লোকের
ভয়ে দিনের বেলা নানা বাড়ি যেতে পারত না।
যেত রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে। গভীর রাতে দাই মা আমি আর মা যেতাম। চকিদারের হাঁক শুনলেই
পাশের জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে পড়তাম। পাড়ার কুকুর গুলিও ছিল বাঘা। ওরে বাপরে। আমাদের
দেখলেই আর বিরাম নেই। শিয়াল বা চোর দেখলে যে কন্ঠে ডাকে ঠিক সেই কন্ঠে চিৎকার জুড়ে
দিত।
স্কুলে যাবার
বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও মা আমাকে স্কুলে দেবার সাহস করে না। বলে লোকে তোরে স্কুলে
ভর্তি নেবে নারে বাবা। শেখার মধ্যে দাই মা কোত্থেকে একটা শিশু শিক্ষা বই এনেদিয়েছিল।
ওই বইয়ের সব আমার কন্ঠস্থ ছিল। মা একটু পড়াশুনা জানত। ভুল শুদ্ধ মিলিয়ে তা দিয়েই
পড়াত। দেখতাম মালিকের বড় বড় ছেলেরা স্কুলে পড়তে যায়। আমি এসে মাকে বলতাম “ও মা আমিও স্কুলে যামু।” কখনও মা বলত আচ্ছা আরেকটু সবুর কর, কখনও
বলত আমরা গরীব মানুষ লেখাপড়া কইরা শিক্ষিত হইয়া কি করবি? এর চাইতে কোন ঘাটে-কর্মে
লাগতে পারস না কি দেখ। শেষে একদিন দাই মা গিয়ে মালিকের হাতে পায়ে ধরে আমাকে স্কুলে
ভর্তি করাতে রাজি করালেন। মালিক নিজে গিয়ে হেডমাস্টারের সাথে কথা বললেন। তবুও হেড মাস্টার রাজি হতে চান না। বলেন দেখুন
সরকার সাহেব আমি একা এই ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে পারি
না। স্কুলে একটা কমিটি আছে ওদের সাথে কথা না বলে আমি
কিছু করতে পারব না। তবে কথা
দিচ্ছি আমি আমার যথা সাথ্য চেষ্টা করব। কারণ আমি মনে করি সমাজে কেউই ছোট নয়। আপনি সাত
দিন পরে একবার খোঁজ নিয়ে যাবেন। শিশু শিক্ষা বইটি যেমন বগল দাবা করে নিয়ে এসেছিলাম ঠিক তেমনি করেই ফিরে আসলাম। এসে দেখি মা আমার কাঁদছে।
জিজ্ঞেস করি “কিরে মা
কান্দস কেন’’? মা কিছু
বলে না। কোত্থেকে যেন দাই
মা গজগজ করতে করতে ঘর আসে ।
জিজ্ঞেস করি কি হইছে?
বলে ওই হারমজাদী আবুলের বউ তোর
মায়েরে মারছে। আহুক আইজকা মালিক দেহামু ওরে কত ধানে কত
চাউল। মা কাঁদতে কাঁদতে মৃদু কন্ঠে বলল “থাক না খালা। অগো
বিচার আল্লার কাছেই দিলাম। আল্লায় এর বিচার করব”।
যখন আমি আরো ছোট তখন পাড়ায় কেউ আমার সাথে খেলতে চাইত না। আমি গেলেই
বলত “ওই জারজ আইছে রে জারজ আইছে”।
জারজ অর্থ ওই বয়সে ওরা কি বুঝত জানি
না, তবে আমিও
খুব একটা কিছু বুঝতাম না। যখন আমার
বয়স ৮-৯ বছর
তখনও একই অবস্থা কেউ আমার সাথে মিশত না। দূরে দাড়িয়ে ওদের ডাংগুলি, মার্বেল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো দেখতাম। তবে
১৩-১৪ বছর যখন বয়স তখন আমার এক ভাল বন্ধু জোটে। পাশের গ্রামে হিন্দু এক ছেলে। নাম সৌরভ।
ওর বাবা মুচি, লোকে ওদের চামার বলে। ওদের গ্রামে ওরাও অত্যন্ত নিচু জাত। নিচু জাত
বলে ওদের সবাই ঘৃণা করে। মরা গরু, ছাগল,
ভেড়ার চামড়া সংগ্রহ করে তা দিয়ে জুতা বানায়, অন্যের জুতা সেলাই করে খায় ওরা। ওর আর
আমার মধ্যে তফাৎ ছিল ও জারজ ছিল না আর আমি জারজ।
শিশুশিক্ষা বই বগল দাবা করে সাতদিন পর আবার মালিকের সাথে
স্কুলে গেলাম। হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকতে একগাল হাসি দিয়ে সুখবরটা দিলেন। বললেন “সরকার
সাহেব আমি ওদের বুঝিয়ে একশর্তে রাজি করিয়েছি। শর্ত হল ওর সব কাজের দায়দায়িত্ব
আপনাকে নিতে হবে।” আমি দূরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলাম। হেডমাস্টার সাহেব আমায় কাছে
ডাকলেন।
জিজ্ঞেস করলেন- তোমার নাম কি?
আমি বললাম রুহুল আমিন।
নামের আগে মোহাম্মদ নাই?
আমি শুধরে নিয়ে বললাম- জ্বী মোঃ রুহুল আমিন।
বললেন তোমার ডান হাত ঘাড়ের পেছন দিয়ে নিয়ে বাম কান ধরো
তো।
আমি কান ধরলাম।
তারপর আমায় শটকে, অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি, মাছের নাম, পাখির
নাম, ফুলের নাম ইত্যাদি ধরলেন। আমি সব গুলোরই উত্তর ঠিক ঠিক দিতে পারলাম। তারপর
হেডমাস্টার সাহেব বললেন “সরকার সাহেব এই নোংরা পোষাকে স্কুলে আসা চলবে না”। একটা
কাগজ দিয়ে বললেন এটা পূরণ করুন। ফরম পূরণ করতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। সবই লেখা গেল
কিন্তু পিতার নামের ঘরটা রাখতে হল খালি।
আমার স্কুলে যাওয়া
শুরু হল। নিয়মিত স্কুলে যেতাম কোনদিন স্কুলে যেতে গাফলত করতাম না। কাউকে কখনও
আমাকে স্কুলে যাবার জন্য তাড়া করতে হয়নি। পড়ার কথাও বলতে হয়নি কাউকে। সবার আগে
স্কুলে গিয়ে ঠিক ঠিক হাজির হতাম। ঝড়-বৃষ্টি-বাদলেও পরোয়া করতাম না। ঝড়-বৃষ্টিতে বড়
মানকচুর পাতা, কলা পাতা মাথায় দিয়ে স্কুলে যেতাম। স্লেট-চক থেকে কাগজ পেন্সিলে
লেখা আরম্ভ করলাম। দুই বেলা মন দিয়ে পড়তাম। একটু বড় হতেই মালিকের ফায়-ফরমাস খাটতে
হতো। আর বন্ধু সৌরভের সাথে সকাল বিকাল মাছ ধরতাম নদী, খালে। বনে-বাদরে ঘুড়ে
বেড়াতাম। ভালো মাছ পেলে হাটে বিকোতাম। তবে আমরা কখনই কারও কোনো কিছু (ক্ষেত থেকে মরিচটা,
পেঁয়াজটা, আলুটা, শাকটা-তরকারিটা) চুরি করতাম না। কেউ কোন কিছু করতে বললে কখনও না
করতাম না। এজন্য অনেকের বাড়িতে মাঝে মধ্যে খেতেও পেতাম। আমেদের প্লেট বসার জায়গা
আলাদা করা। এলাকায় যেকোন অনুষ্ঠানে আমারা আগ বাড়িয়ে কাজ করতে যেতাম। এতে সামান্য
টাকা সাথে পেট পুরে খেতেও পেতাম। তবে মাঝে মাঝে কেউ কিছু করতে বললে না বলতে হতো।
কারণ তখন আমার স্কুল থাকত। স্কুল থাকলে বলতাম “আমার যে স্কুল আছে।” এজন্য অনেকে হিংসা বা রাগ থেকে মুখ ভেংচে বলত “আমর যে স্কুল আছে, ফকিরের ছেলের নাম মিয়া সাহেব। যা যা পড়ে জজ
ব্যারিস্টার হ গিয়ে। তোকে এই ত্রিসীমানায় যেন না দেখি। হারামজাদা।” আমি কখনও উত্তর করতাম না। মাথা নিচু করে চলে আসতাম।
সৌরভ কখনও স্কুলে যায় নি। আমি কতবার ওকে অ-আ শিখাতে
চেয়েছি। একবার মাটিতে আঁক কষে অ-আ লিখে দিয়ে বলেছিলাম ওর ওপর হাত মোচ করতে। কয়েক
বার চেষ্টা করে ক্ষণিক পরে কি হলো ও রেগে উঠে বলল “ধুর রাখ এইসব আমারে
দিয়া হইবো না। এই সব তোর মতো যারা বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে ওগো জন্য। যা যা দূর
হ আমর সামনে থিকা। ” বলেই দৌড়ে একদিক চলে গেলো। এত ডাকলাম
একবারও শুনল না। সেই রাগ ভাঙাতে আমার দুদিন সময় লেগেছিল। ওর বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস
করতেই ওর মা বলল “জানি না বাবা। কই যে গেলো ছাওয়ালডা। দুপুরে কিছু খায় নাই। তুমি
একটু খুইজা আইনা দেও না বাবা।” পৃথিবীতে এই একটা মানুষকে আমার মা আর দাইমার পর আপন
মনে হত। ওর বাপ খুব মদ খেত, আর খুব বদমেজাজি ছিল। সৌরভের মাকে কথায় কথায় মার-ধোর
করত। কালো দানবের মত শরীর। হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়ালে গাঁয়ে কারো সাধ্য নেই চোখ তুলে
কথা বলে। যখন তখন যার তার সাথে মাথা ফাটাফাটি লেগে যেতো। একটু হুশ আসলেই আবার গিয়ে
তার কাছে মাফ চেয়ে আসত। এখনও একটি মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় শহরে গিয়ে।
আমাদের সম্ভাব্য সব গোপন আস্থানায় খোঁজ নেবার পরে যখন
বাড়ি ফিরছিলাম তখন দেখি আমাদের মালিকের বাড়ির পেছনের বাগানে একটা কাঁঠাল গাছে
হেলান দিয়ে ও বসে আছে। ওর পুরোনো বাঁশের বাঁশি হাতে চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছে। ও খুব
ভাল বাঁশি বাজাত। রাতে যখন আকাশে চাঁদ উঠত তখন নদীর ধারে গিয়ে বসতাম। পিছনে থাকত
চাঁদ আর সামনে আমাদের আবছা নাতিদীর্ঘ ছায়া পড়ত। ও বাঁশি বাজাত ঘন্টার পর ঘন্টা, আর
আমি তন্ময় হয়ে নিরবে শুনতাম। মনে হতো ওর বাঁশির প্রাণ কাড়া সুর শুনে রাতের
জোৎস্না গলে পড়ছে। কখনো কান্না হয়ে, কখনও বা আনন্দের বার্তা নিয়ে।
গোসল দিয়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোষাক পড়ে, মাথায় চপচপে
করে নারকোল তেল দিয়ে সিঁথি কেটে স্কুলে যেতাম। টেরির দুই পাশ বেয়ে তেল গড়িয়ে পড়ত।
তখন ধারণা ছিল বেশি তেল দিলে বোধহয় লোকে ভদ্র বলবে। যত তেল ততো ভদ্র। তাই কদিনেই
তেলের শিশি খালি হয়ে যেত। মা জিজ্ঞেস করত কিরে রুহুল তুই মাথায় এত তেল দেস কেন রে?
কদিন ভয়ে ভয়ে তেল মাখতাম তার পর যেই সেই। ধীরে ধীরে স্কুলে সুনাম বাড়তে লাগল আমার।
পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাই। শিক্ষকদের সবার দৃষ্টি ছিল আমার ওপর আশাও ছিল। এই
স্কুলের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম। শিক্ষকেরা সবাই খুশি হলেন। প্রথম প্রথম শিক্ষকেরা
আমায় অনেক অপমান করত; বলত- “ওরে ক্ষেত তোরে দিয়ে আর যাই হোক
লেখাপড়া হবে না রে।” তবে কিছু দিনের মধ্যে ওদের এই ভুলটা
ভেঙে যায়। তখন অনেকে সদয় হন আমার প্রতি। ভালো ব্যবহার করেন। যেদিন স্কুল ছেড়ে চলে
আসব সেদিন সব শিক্ষেকেরা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন “
তুই অনেক বড় হবি বাবা, তুই তোর মায়ের দুঃখ ঘোঁচাতে পারবি। অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি
পেয়েছিলাম। কৃতিত্বের সাথে হাই স্কুলও শেষ করি। এবার আমার পালা এলো পৃথিবীর
পাঠশালায় পাঠ নেবার। শহরে যেতে হবে কলেজে পড়তে। আমার বাড়ি থেকে জেলা শহর ৩৫কি. মি.
দূর। মাকে ছেড়ে যেতে হবে, দাইমা, সৌরভ, গ্রাম, গাছ-পালা, কত চেনা নদী, মাটি এই সব
কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। জন্মের পর যেখানে বেড়ে উঠেছি, যে জায়গাকে মায়ের পরে আপন
বলে ভাবতে শিখেছি। সেই চির চেনা ভুবন ছেড়ে যেতে হবে। ভাবতেই বুকে মরুর ঝড় বয়ে
গেলো। মানুষের আচরণ দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে
গিয়েছিলাম। তাই বড় হয়ে আর কখোনও কাঁদিনি। চোখে পানি আসত না। আমি যে গ্রামে বড়
হয়েছি সে গ্রামে খুব কম ছেলেই কলেজে যেতে পেরেছে। তাই আমার গ্রামের অনেক মানুষের চক্ষুশূল হয়েছিলাম আমি। আমার কলেজে যাওয়া লেখা
পড়া সবকিছুতেই ওদের চোখ কটকট করত। গ্রামের মানুষ কেন যেন চায় না কারো ভালো হোক,
কেউ ভালো কিছু করুক, ভাল খাক-পরুক, কারও অভাব দূর হোক, কেউ লেখা পড়া করে ভালো
চাকরি করুক ইত্যাদি ইত্যাদি। কারো ভালো হলে মনেমনে খুব হিংসা করে কিংবা প্রত্যক্ষ
বা পরোক্ষ ভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারত না
কারণ সরকার সাহেব ছিলেন আমাদের আশ্রয়দাতা। আমাদের আশ্রয়দাতার দৌলতেই আজ আমি এ
পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ওনার ঋণ শোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষ জীবনে
বেচারা অনেক কষ্ট পেয়ে মরেছেন। মনের কষ্ট। টাকা পয়সা যথেষ্টই ছিল। কিন্তু মনে সুখ
ছিল না। ওনার দুই ছেলের একজন ঢাকা সরকারি চাকরি করতেন। আর একজন ব্যবসা করতেন। তারা
বছরে দু একবার বাবাকে দেখতে আসতেন। তাই দুই বুড়ো-বুড়ির ছিল টোনাটুনির সংসার।
নিঃসঙ্গ জীবন। মাঝে মাঝে অবশ্য ছেলে নাতিদের কাছে যেতেন। কিন্তু গ্রামের
চাষবাস-গেরস্তি কাজ রেখে বেশি দিন থাকতে পারতেন না। ছেলেরা চাষবাস ছেড়ে দেবার কথা বললে বলতেন “তাকি হয়রে বোকা। সাত পুরুষের
বসত ভিটা ছেড়ে আসি কিভাবে। তোরা নাহয় পাষান। আমি ওসব ছেড়ে আসতে পারব না।”
শহরে গিয়ে একটা
বাড়িতে জায়গির থাকা শুরু করলাম পাশাপাশি কিছু ছাত্র পড়াতাম। তাতেই হত খরচ, কাগজ
কলম, বই হয়ে যেত। মা-দাইমাকে কিছু দিতেও পারতাম। ওরা নিতে চাইত না। তবে খুব খুশী
হতো। দাইমা তো পাড়ার সবার কাছে গল্প করে বেড়াত। কলেজ জীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়
হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম বাংলায়। কৃতিত্বের সাথে পাশও করলাম। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম এম.এ. তে । খুব ভালো পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
হিসেবে যোগ দিলাম। কর্মজীবন শুরু হল। এর মধ্যে দাইমাও মারা গেলেন। কমাস যেতেই মাকে
ঢাকা নিয়ে এসে উঠলাম এক ভাড়া বাসায়। বছর ঘুরতেই সুদিন সুসময় দেখে বিয়ে করলাম এক
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে। দুবছর পর আমার অন্ধকার ঘর আলো করে এল এক ফুটফুটে
চাঁদের কণা। আমার ছেলে ভূমিষ্ঠ হবার পর ওর প্রথম ক্রন্দন শুনে যে কথাটি আমার মনে
উদয় হলো “আমি জারজ, কিন্তু আমার ছেলে জারজ না।”
মানুষ হবার যে
লড়াই আমি শুরু করে ছিলাম তাতে আমি সফল। লড়াই এখানেই শেষ না। এ লড়াই যুগ যুগ ধরে
চলছে। আমি যুদ্ধ যেখানে শেষ করব আমার
উত্তরসূরী সেখান থেকে শুরু করবে। আর এ যুদ্ধের মাধ্যমে আমার উত্তরসূরী হয়ে
উঠবে আরও মানুষের মত মানুষ।